১লা চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ১৫ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই রমজান, ১৪৪৬ হিজরি
সর্বশেষ

গরিবের জন্য এই শিক্ষাটা অনেক কিছু বাহে’

জালাল উদ্দিন/নিউজ টোয়েন্টিফোর মিডিয়াঃ

রংপুর মহানগরে নিরক্ষর বয়স্ক নারী-পুরুষদের মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়ন ফোরাম। গত চার বছর ধরে পিছিয়ে পড়া দরিদ্র নারী ও পুরুষদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে শিক্ষাদান করে চলছে এই সংগঠনটি। বর্তমানে নগরীর তিনটি ওয়ার্ডে এই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হলেও ভবিষ্যতে প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে ইউনিট খোলার পরিকল্পনা রয়েছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে রংপুর মহানগরীর ১৮নং ওয়ার্ডের কেরামতিয়া মসজিদ সংলগ্ন সংগঠনটির তৃতীয় ইউনিটে গিয়ে দেখা গেছে, শিক্ষাবঞ্চিত বয়স্ক নারীদের একটি অংশ ‘সোনার মানুষ গড়ি’ কর্মসূচিতে লেখাপড়া করছেন। তাদেরকে অক্ষর জ্ঞান শেখানোর পাশাপাশি প্রচলিত কুসংস্কার ও প্রতারণা মুক্ত হওয়ার কৌশল এবং নীতি-নৈতিকতা সম্পর্কে সচেতন করছেন প্রশিক্ষক। সঙ্গে এসব বয়স্ক নারী-পুরুষদেরকে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দেওয়া হচ্ছে প্রাথমিক ধারণা। নগরীর মুন্সিপাড়া পাড়া ও কেরানীপাড়ার অন্তত ৬০ জন নারী ও পুরুষ রয়েছেন এই ইউনিটে। শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহে ছয় দিন বিকেল থেকে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক তারা শিখছেন গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ কিছু বিষয় ও অক্ষর জ্ঞান।

সেখানে কথা হয় চল্লিশোর্ধ্ব রাবেয়া খাতুন (ছদ্মনাম) নামে এক নারীর সঙ্গে। তিনি সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অন্য এক মহল্লার দুটি বাসাবাড়িতে রান্নাবান্নার কাজ করেন। বিনিময়ে কিছু খাবার আর মাস শেষে যা আয় হয় তাই দিয়ে টেনেটুনে চলছে রাবেয়ার সংসার। বাল্যবিয়ের শিকার রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘মোর স্বামী রিকশা চালায়। দুইটা ব্যাটাক (ছেলেকে) মাদ্রাসাত ভর্তি করে দিচু। হামরা স্বামী-স্ত্রী দুইজনে মূর্খ মানুষ, ন্যাকাপড়া নাই। হামরা কোনো অক্ষর চিনি না। মেলা মাইনসে হামাক ঠকাইচে (প্রতারণা)। তখন এত কিছু বুঝিও নাই। অ্যালা এই স্কুলোত আসিয়া তো নিজের নাম ন্যাকা (লেখা) শিখছি।

এক থাকি শুরু করি পঞ্চাশ পর্যন্ত অক্ষর শেখা হইছে। আগে দোকানোত বাকি খাইলে হিসাব বুঝি নাই, কিন্তু অ্যালা একনা একনা বুঝবার পাই। অ্যাটে বিকেল থাকি সন্ধ্যা পর্যন্ত মেলা কিছু শেখা হওচে।’ এই শিক্ষা কার্যক্রমে যারা অক্ষর জ্ঞান শিখছেন, তাদের সবাইকে বিনামূল্যে বই, খাতা, কলমসহ প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ করছে সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়ন ফোরাম। বিভিন্ন বয়সী নারী ও পুরুষদের হাতেকলমে শেখানো হচ্ছে সাধারণ কিছু বিষয়। স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবে কী কী রোগ হতে পারে এবং প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কেও দেওয়া হচ্ছে প্রাথমিক ধারণা। এখানে যা শেখানো হয়, তার ওপর নেওয়া হয় মূল্যাযন পরীক্ষা। গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থার বাইরে বয়স্কদের জন্য নেওয়া এই কার্যক্রমে কোনো পারিশ্রমিক নেন না প্রশিক্ষকরা।

বরং সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যাদের একেবারেই অক্ষর জ্ঞান নেই ও সাধারণ বিষয়েও অজ্ঞ, তাদেরকে এমন কার্যক্রমে যুক্ত হওয়ার আহ্বান তাদের।

অন্যদিকে নগরীর ২৫ নং ওয়ার্ডের শালবন মিস্ত্রিপাড়ার ইউনিটে রাতে বয়স্ক নারী-পুরুষরা লেখাপড়া করছেন। অন্য ইউনিটগুলোর মতো এখানেও পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যাই বেশি। যাদের বেশির ভাগই বাসা-বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করেন, কেউবা আবার স্বামীর সংসার দেখাশোনা করছেন। এ ইউনিটে আছেন নারী শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশা-ভ্যান চালকসহ বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে মনোযোগ দিয়ে নিজের নামটা লিখছেন পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী জহুরা খাতুন (ছদ্মনাম)। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন, তারা আলাদা থাকে।

সংসার চালানোর মতো কেউ না থাকায় জহুরা একটি ভ্যানে ফেরি করে গ্রামে ঘুরে শাকসবজি বিক্রি করেন। সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে রাতের বেলা পড়তে আসেন শালবন মিস্ত্রিপাড়ার এই ইউনিটটিতে। জহুরা খাতুন বলেন, ‘টাকা তো কমবেশি সবাই চেনে। কিন্তু একসাথে বেশি টাকার হিসাব করা তো মুশকিল। এই স্কুলোত আসিয়া অ্যালা মুই টাকা গণনা করা শিখছু। কোন শাকসবজিত কি ভিটামিন আছে, সেটাও জানো। আগে তো অনেক কিছুই অজানা ছিল। অ্যালা হাতের নখ কাটা, স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ, স্বাক্ষর করা, নাম লেখাসহ অনেক কিছুর গুরুত্ব সম্পর্কে মোর জানা হইছে। হামার মতো গরিবের জন্যে এই শিক্ষাটা অনেক কিছু বাহে।’

জানা গেছে, রংপুর মহানগরীর ১৮ ও ২৫ নং ওয়ার্ড ছাড়াও ১৭ নং ওয়ার্ডে ‘সোনার মানুষ গড়ি’ কর্মসূচির আরেকটি ইউনিট রয়েছে। প্রতিটি ইউনিটে ৪০-৬০ জন করে শিক্ষার্থীরা। তবে শিখতে আসা নারীদের সংখ্যা ও অগ্রাধিকার বেশি। এক বছর মেয়াদের এ শিক্ষা কার্যক্রমে অক্ষর জ্ঞান চেনানো ও নাম লেখা ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ ১৫টি বিষয়ে হাতেকলমে প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে। ইউনিটগুলোতে শিখতে আসা নারী-পুরুষদের হাতের নখ কাটা, স্বাস্থ্যসম্মত সুষম খাবার গ্রহণ, প্রয়োজনীয় ওষুধের নাম, জ্বরে থার্মোমিটারের ব্যবহার, ফোন ব্যবহার, জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর, লোভনীয় অফারে প্রতারিত না হওয়া, প্রচলিত কুসংস্কার সম্পর্কে ধারণ দেওয়াসহ স্বাক্ষর করা, অক্ষর চেনা ও গণনা করার মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেখানো হয়।

এমন উদ্যোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবু বলেন, আমাদের সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র কর্মজীবী নারীরা সবসময় প্রচলিত শিক্ষার বাইরে থাকছেন। তাই শিক্ষাকে তাদের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। নিরক্ষর ব্যক্তিরা কখনো নিজেদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারেন না। পাশাপাশি তারা নিজেদের এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের স্বাস্থ্য বিষয়ে অধিকাংশ সময়ে উদাসীনতা দেখান। এ কারণে আমরা সংগঠনের কয়েকজন ব্যক্তি উদ্যোগ থেকে ‘সোনার মানুষ গড়ি’ কর্মসূচি শিরোনামে এ ধরণের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছি।

সংগঠনটির সভাপতি এস এম পিয়াল বলেন, ১৯৯০ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর আমরা এলাকার সুবিধাবঞ্চিত শিশু-কিশোরদের বাসায় ডেকে এনে পড়াতাম। তখন থেকে ইচ্ছা ছিল বড়দের জন্য কিছু করা যায় কিনা। দিনে দিনে সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগে প্রাথমিকে শিশুদের ঝড়ে পড়া কমে আসছে। কিন্তু অনেক নারী-পুরুষ রয়েছে যারা একেবারেই শিক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। আমি তাদের নিয়েই কাজ করতে ২০১৭ সাল থেকে ‘সোনার মানুষ গড়ি’ কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। আমরা শিখতে আগ্রহী বয়স্ক নারী ও পুরুষদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় ছাড়াও অক্ষর জ্ঞান শেখানোর কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছি। ইতোমধ্যে নগরীর তিনটি ওয়ার্ডে এই কার্যক্রম চলছে। আমরা চেষ্টা করছি প্রতিটি ওয়ার্ডে ছোট পরিসরে হলেও একটি ইউনিট চালু করার। এ ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নিরক্ষর মানুষ সহজে প্রতারণার শিকার হন।

তাদের মধ্যে সচেতনতা বোধ কম। সমাজে বিদ্যমান কুসংস্কার এবং অন্যায় দূর করতে পিছিয়ে পড়া এসব মানুষদের শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। যুগের তাড়নায় আমাদের অনেকেই যখন অতি ব্যন্ত এবং জীবন সংগ্রামে অনেকেই যখন আমিত্বে ডুবে আছি, ঠিক এ রকম এক সময়ে ‘সমাজ পরিবর্তন ও উন্নয়ন ফোরাম’ প্রান্তিক মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের এ ধরনের কার্যক্রম দেখে যদি কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন পাড়ামহল্লায় এটা শুরু করে, তখন আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক হবে।

Facebook
Twitter
Pinterest
Reddit
Skype
Email
LinkedIn